ভূমিকম্পের সময় জেগে থাকলে আতঙ্কে ছুটোছুটি, হৈচৈ করা যায়। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায়, বিশেষত গভীর রাতে মাটি কেঁপে ওঠলে সেসব তুলনামূলক কম হয়। টেরই পান না অনেকে। তবে কেউ কেউ যেহেতু অন্যদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকেন, তাই আতঙ্ক বিস্তারের ভূমিকায় নিষ্ঠাবানের অভাব হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ছোট এবং মাঝারি ভূ-কম্পনে জনমনে যথেষ্ঠ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এমনিতে বহুতল ভবন কাৎ হয়ে অন্য ভবনের গা ছুঁয়ে থাকার দৃশ্য, ভবন ধ্বসের শিকার শত শত শ্রমিকের বিকৃত লাশের ছবি, কিংবা ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধারকৃত মুমূর্ষের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরা উদ্বিগ্ন টিভি সাংবাদিকের কাণ্ডজ্ঞান, দূর্ঘটনার সতেরো দিন পরেও ধ্বংসস্তুপ থেকে একজনকে জীবিত উদ্ধারের অলৌকিক(!) ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। কিন্তু টেকটোনিক টেনশনের ভয়াবহ কুপ্রভাবের ঝুঁকিতে থাকা এ দেশটির জীবিত জনগণের জীবনে এখনও হাইতি (২০১০-এর ১২ জানুয়ারি), চীন (২০১০-এর ১৪ এপ্রিল), জাপান (২০১১-র ১১ মার্চ), নেপাল (২০১৫-র ৫ এপ্রিল) কিংবা ভারতের (২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারি) সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের অনুরূপ ভয়াবহতা স্পর্শ করেনি। এটিকে আমাদের জন্য আশীর্বাদ ভেবে শান্তি পাওয়া যেতে পারে; আবার দেশে গত কয়েক বছরে মৃদু যেসব কম্পন অনুভূত হয়েছে, সেগুলোকে বিরাট কোনো ঝাঁকুনির সূচনা সঙ্গীত ভেবে নিয়ে সর্বদা আতঙ্কিত থাকার সিদ্ধান্তেও অটল থাকা যেতে পারে। মানুষের মনে আর মাটির তলে কী কী ঘটে তার সব খবর এখনও মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
বেঁচে থাকলে সম্ভব-অসম্ভবের হিসেব-নিকেশের সময় পাওয়া যাবে। একদিন নিশ্চয়ই ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস নির্ণয়ের কৌশল আবিষ্কৃত হবে। ভূ-তত্ত্ববিদগণ কাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের অবদান রাখার তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু দুই ডিজিটের আয়ুপ্রাপ্ত জীব হিসেবে বিরাট কোনো ভূঁইকাঁপের সম্ভাব্যতাকে আমলে নিয়ে নিজের এবং প্রিয়জনের জন্য শব্দের বিন্যাসে কিছু কথা বলবার ইচ্ছে যদি হয় কারও, তবে তাকে তুচ্ছজ্ঞান করা না করায় কী আসে যায়? মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা সুন্দর। উপায় নেই জেনেও হাজার বছর, লক্ষ বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
মানুষের আয়ুষ্কাল হাজার বছর হলে জমির দাম নিশ্চয়ই এখনকার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি হতো। বেকারত্বের ভয়াবহতা কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যেতো। খাদ্য সংকটে কাসাবার কেজি হাজার হলে মাছ-মাংস লাখ টপকাতো। এক জীবনে দু-চার-দশটা বিয়েটিয়ে খুবই স্বাভাবিক রেওয়াজ হতো। মাটির উপর ভবনের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উড়োজাহাজের তেলখরচ আকাশ ছুঁয়ে যেতো। তবুও কখনও জলোচ্ছ্বাসে, ভূমিকম্পে মৃতদের জন্য স্বজনদের কষ্ট কম হতো—এমন ভাববার অবকাশ নেই। যে কোনো সময় প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়ে ‘লাশ’ হয়ে যাওয়াটাই প্রাণশীলের পরিণতি–ঠেকানো অসম্ভব। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রত্যাশা সবাই করে। ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগ, দূর্ঘটনার নির্মম শিকার হতে ইচ্ছে করে না।
রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে ফেরার বছর পাঁচেকের মাথায়ই বেশ বড়োসড়ো ভূমিকম্প হয়েছিলো। নজরুলের জীবদ্দশায় হয়েছিলো অন্তত পাঁচটি। জীবনানন্দের জীবনেও এক হালি ভুমিকম্পের স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো। এঁদের কেউ, কিংবা অন্য কোনো কবি এই প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছেন কিনা জানা নেই। যদি তেমনটি না হয়ে থাকে, তবে তা কেনো হয়নি তার চেয়ে বড়ো কথা, ভূমিকম্প কাব্যিক ঔদাসিন্যের শিকার। সচেতন কবিগণ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। মৃত্যু নিয়ে কবি, সাহিত্যিকগণ অনেক ভেবেছেন, লিখেছেন। জনপ্রিয় একজন লেখক মৃত্যু নিয়ে খুব রসিকতাও করেছেন। তিনি যথেষ্ঠ সাহসী ছিলেন নিশ্চয়ই। অবশ্য মৃত্যুকে খুব ভয় পেলে, বা ভুলে থাকলেও কারও মরণ সুখের হবে এমন গ্যারান্টি নেই। কথা হলো, মরণ সংক্রান্ত ভয়, বিস্মৃতি বা স্মরণ নিয়ে বা না নিয়ে সর্বোপরি বেঁচে থাকায় মনোনিবেশ মঙ্গলজনক। মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা সুন্দর।